গল্প - সাদা কালো তারা
সেখ ওয়াসিম গুল
দৌড়তে দৌড়তে চলন্ত ট্রেনের লাস্ট কম্পার্টমেন্টে উঠে ফাঁকা সিটে বসেই হাঁপাতে লাগলাম দুজনেই। সরস্বতী পুজোর দিন। অফিস কাছারি বন্ধ। ভীড় প্রায় নেই বললেই চলে।
- উফ্, কী গরম লাগছে রে! জ্যাকেটের ভীতরে জামাটা ভিজে গেছে পুরো। - বললো সুকমল।
জ্যাকেটটা খুলে ভাঁজ করে গুছিয়ে কোলে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো।
বললাম- শীত আর তেমন নেই। তুই যা বস্তা চাপিয়ে বেরিয়েছিস দেখে মনে হচ্ছে সুইজার ল্যান্ড যাচ্ছিস।
শীত এবং শীতের আমেজ হারিয়ে ফেলেছি আমরা ইদানিং। শীত-বস্ত্র আলমারির শোভা বর্ধন করে করে শেষে দু-এক বছর পর পরই জঞ্জালে পরিণত হতে থাকে।
তারকেশ্বর লোকাল জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে পোঁ পোঁ বাঁশি বাজিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে স্পীড নিয়েছে ততক্ষণে। আমি জানালার দিকে তাকিয়ে গাছ-পালা, ঘর-বাড়ি দ্রুত সব পিছনের দিকে যেতে দেখলাম।
ট্রেনের জানালার ধারের সিটের আলাদা আকর্ষণ আছেই। ধীরে ধীরে হেলতে দুলতে শব্দ করে প্রকাণ্ড ও জনবহুল শিয়ালদা স্টেশন ছেড়ে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। স্টেশনকে ছেড়ে যেতেও কী ট্রেনের কষ্ট হয় কখনও?
সুকমল জানা; বাড়ি মেদিনীপুর; কোলকাতার কোনো এক মেসে থাকছে কলেজে পড়ার জন্য। আমরা একই কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সুকমল ফোন মারফত যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছে তাকে এখনও চোখে দেখেনি। বেশ কয়েকদিন তার কথাই টুকিটাকি বলে গেছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বন্ধু মহলে। মেয়েটির নাম রূপসা, থাকে তারকেশ্বরে। কলেজে যেটুকু অফ টাইম হয় সুকমলকে ফোন কানে, প্রায় শোনা যায় না এমন মিনমিনে আলাপচারিতায় ব্যস্ত দেখেছি আর মাঝে মাঝেই হেসে উঠতে দেখেছি এই কদিন। কিছু জিজ্ঞেস করলেও মুচকি হাসত। পরে কিছুটা চাপাচাপিতে অল্প কিছু কথা জানতে পারলাম।
ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে হঠাৎ সুকমল বললো;- তারকেশ্বর যাব সরস্বতী পুজোর দিন। তোকে সঙ্গে যেতে হবে। বন্ধুদের কারোকে জানাবি না।
বন্ধু বলে কথা; না করলাম না।
আজ বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মা'কে বলে এলাম- তারকেশ্বর যাচ্ছি সুকমলের সাথে। ফিরতে রাত হতে পারে।
মা বললো;- কত রাত হবে?
-- সঠিক বলতে পারিনা... বলতে বলতে ব্যস্ত সমগ্র হয়ে রাস্তায় নেমে হনহন করে হাঁটতে লাগলাম।
ট্রেনেই তিন-চার ঘন্টা লাগবে। কোথাও হোটেল পেলে একফাঁকে খেয়ে নিতে হবে আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম দুজনেই। ট্রেনে হকার উঠলে দু-প্যাকেট বাদাম কিনে দুজনে খেতে লাগলাম।
সুকমল বলে উঠল;- কত্তো কত্তো রঙ! চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে রঙের ছটা। লাল নীল বাসন্তী সবুজ, মন মাঝি তুই এখনও কেন রইলি রে অবুঝ?
আমি হেসে ফেললাম। এটা তার চালাকি ছিল। কোনো এক স্টেশন থেকে একদঙ্গল রংবাহারি শাড়ি পরিহিতা সুন্দরী যুবতী উঠে অকারণে হইচই হাসাহাসি করে ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট মুখরিত করছিল। তাদের দেখে আমরা সোজা ও সজাগ হয়ে বসেছিলাম আর তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলামও বটে। ভালোই লাগছিল।
আমি বেরসিকের মত সুকমলকে বললাম ;- সাদা বা কালোকে রঙ বলা যায় কী?
-- সাদা সাতটি রঙের সমাহার আর কালো সাতটি রঙের শোষক।
-- হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। কোনো বস্তু যদি আলোর সাতটি মৌলিক রঙকেই প্রতিফলিত করে তখন বস্তুটি সাদা দেখি এবং শোষণ করে নিলে কালো। এখন যদি বলি সবুজ রঙের পাতায় সবুজ রঙ নেই, তাহলে কথাটা কী ঠিক হবে?
-- কীভাবে?
-- পাতাতে সূর্যের আলো পড়লে সবুজ ছাড়া অন্যান্য রঙগুলোকে খেয়ে নেয় আর সবুজ রঙকে বমি করে দেয়। তাহলে শুধুমাত্র সবুজ থাকল না পাতার মধ্যে। সেরকমই লাল শাড়িতে লাল ছাড়া বাকি সমস্ত রঙ থাকলেও কেবল লাল থাকে না বা নেই।
-- কেন রে! লাল শাড়ি পছন্দ?
-- তুই তো আহাম্মকের মত কতই না রঙ দেখছিস। সবই ভুল; সবই ইলিউশন। আর সেই অর্থে সাদা বা কালো আদৌ কোনো রঙ নয়।
দেখতে দেখতে কত কথা, মাঠ-ঘাট, স্টেশন, হাঁকাহাঁকি, বাউলের গানের সুর কেটে গেল। তারকেশ্বর স্টেশনে এসে ট্রেনটা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।
আমরা নেমে এলাম। স্টেশন থেকে একটু এগিয়ে চায়ের দোকানে চা খেলাম, সিগারেট ধরালাম। সুকমল ততক্ষণে রূপসাকে ফোন করে জেনে নিল ঠিক কোন জায়গাটায় যেতে হবে। এগোতে থাকলাম রূপসার পথনির্দেশে। কিছুদূর গিয়ে রাস্তার ডানদিকে একটা পার্কের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো সুকমল। আবার ফোন করল। জানতে চাইল কোন জায়গাটায় সে আছে। পার্কে জোড়ায় জোড়ায় যুবক যুবতী ছাড়াও বিভিন্ন বয়সের কাপল বা কাপল নয় এমন মানুষ বসে দাঁড়িয়ে গল্প গুজবে মেতে আছে। আইসক্রিম বাদাম জাতীয় খাবার ও পানীয় নিয়ে বিক্রেতারাও যে যার পশরা সাজিয়ে এথায় ওথায় বসে আছে নয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সুকমল দূর থেকেই লক্ষ রেখে ফোন কানে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ একটু থেমে বললো;- তুই সুকমল হয়ে যা এখন আর আমি সুমন।
-- কেন? কী হল?
-- আহ্! যা বলছি কর্ না। তুই গিয়ে প্রথম কথা বলবি সুকমল পরিচয়ে। ঐ যে, বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে যে মেয়েটা এগিয়ে আসছে আকাশী শাড়ি পরা একটা মেয়ে আর একটা ছেলে সঙ্গে।
-- হ্যাঁ কিন্তু কেন? কিছু বুঝতে পারছি না তো! কী বলবো আমি?
ততক্ষণে তারা তিনজন এগিয়ে এসে একেবারে সামনে।
সুকমল তড়িঘড়ি বলে উঠলো;- কী রে সুকমল আলাপ করিয়ে দে আমার সঙ্গে তোর রূপসার।
আমি সম্পূর্ণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম তার সঙ্গে এক তীব্র ঘৃণা বিষাদ আর বিষন্নতার গ্রাস করলো যেন এক নিমেষে। ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে নিজেকে সামলে নিলাম; বন্ধুত্বের কারণে যতটা নয় তার থেকে বেশি রূপসার কথা ভেবে।
সুকমল হয়ে রূপসার সঙ্গে সুমনের পরিচয় করিয়ে দিলাম। রূপসাও তার সঙ্গে আসা ছেলেটা আর মেয়েটার আলাপ করিয়ে দিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ছেলেটা আর মেয়েটা বিদায় নিল সেখান থেকে।
এবার আমরা তিনজন; আমি (এখন সুকমলের ভূমিকা পালন করছি), সুমন আর রূপসা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাউই করছি।
সুমন বললো- কীরে, কতদিন শুধু কথাই বলে গেলি; আজ রূপসাকে দেখে এরকম ক্যাবলার মত হয়ে গেলি কেন? আচ্ছা বুঝেছি, আমার জন্য অসুবিধা হচ্ছে বুঝি? আমি তাহলে ঐ চা দোকানে বসে চা খাই আর তোরা দুজন একান্তে গল্প কর।
বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে দন্ত-বিকশিত করে হন্ত-দন্ত হয়ে পা বাড়ালো চায়ের দোকানেরর দিকে। আমি কিছু বললাম না শুধু তার দিকে তাকালাম আর সে আমার চোখের দিকে তাকাতে না পেরে মুখ নিচু করে চল গেল।
রূপসা আমার দিকে তাকালো, হাসলো। একটু এগিয়ে গিয়ে সিমেন্ট বাঁধানো পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসতে বললো। দুজনে বসলাম বেঞ্চে। দুজনেরই যেন ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগলো। দুজনেই অস্বস্তিটা কাটানোর আপ্রাণ চেষ্টাও করতে লাগলাম। কিন্তু অস্বস্তি রয়েই গেল যতক্ষণ ছিলাম। একে অপরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাঁধানো পুকুরের জল, গাছপালা আর অন্যান্য মানুষদের দেখতে থাকলাম দুজনেই। যত সময় যাচ্ছে অস্বস্তিটা বাড়তেই রইল।
কয়েকটা হাল্কা কথা বিনিময়ের পর রূপসা কী বুঝলো জানিনা; তবে সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে পড়াশোনার কথা বলতে শুরু করলো। কলেজ, সাবজেক্ট, ভবিষ্যত পরিকল্পনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হ্যাঁ বা না-এ উত্তর দিচ্ছি দায়সারা গোছের। কয়েকটা শুকনো কথা আমিও সুকমল হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম বটে রূপসাকে। সে তখন হ্যাঁ, না বলে কথা শেষ করলো। কারণ কথার খেই হারিয়ে যাচ্ছিল কোথাও যেন।
রূপসা হঠাৎ খুব শান্ত ধীর ও কঠিন গলায় বলে উঠল;- এই যে তোমার গলার আওয়াজ হঠাৎ বদলে গেল, হঠাৎ ফোন থেকে সামনে আসতেই সব যেন অন্য রকম হয়ে গেল; এই অভিজ্ঞতা আমার এই নিয়ে বেশ কয়েকবার হলো। আমি তো মিথ্যা কথা বলি না, পছন্দও করি না। এখান থেকে সোজা বাড়িতে গিয়েই আগে স্নান-ঘরে ঢুকবো। খুব করে স্নান করবো। ভাল করে সারা শরীরে সাবান ঘষে ঘষে বালতির পর বালতি জল দিয়ে স্নান করবো। স্নান করতেই থাকবো; করতেই থাকবো। সব ধুলো বালি গ্লানি সম্মানহানী ধুয়ে ফেলতে চেষ্টা করবো। মাঝে মাঝে মনে হয় স্নান ঘরে ঢোকার পর আমি যেন কোনোদিনই আর বেরোতে না পারি। ভগবান ওখানেই আটকে রাখে না কেন আমি বুঝতে পারি না। তার গলাটা যেন কেঁপে গেল।
আজ তবে উঠি! এই কাগজটা নাও। আমার ফোন নাম্বারটা লিখে এনেছিলাম এই কাগজের টুকরোতে। বাড়ি পৌঁছে একটা মেসেজ করে দিও। বুঝবো তুমি নিরাপদে বাড়ি ফিরেছো।
আমি চুপচাপ হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলাম। ও বিদায় জানালো। আমি তখনও চুপ।
বাড়ি ফিরে কোনো মেসেজ বা ফোন করতে পারিনি। মধ্যরাতে ছাদে উঠে মিটমিটে তারাদের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম খেয়াল নেই। গভীর বিষাদের হাহুতাস ঝরে ঝরে পড়ে যেন আশপাশের বাতাস উষ্ণ করে তুলেছে। রাত যখন শেষ হয়ে এলো প্রায়, সম্বিৎ ফিরতে দেখি তারাগুলো একবার সাদা হচ্ছে আর একবার কালো হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
বজবজ, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, কোলকাতা- ১৩৭
0 মন্তব্যসমূহ