Ad Code

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

মোহাঃ সাদেকুল ইসলাম

 



মাখনা


হরিশ্চন্দ্রপুরের আমবাগানের পাশে অস্থায়ী ঝুপড়ি সব। এগুলো ফরিয়াদের বসতি। দ্বারভাঙ্গার পাহাড়ভূমি ছেড়ে এসেছে ফরিয়ারা। মাখনাচাষী সব। কোমর মাপের পচাজল এদের গা-সওয়া। কখনো বক্ষজলের পচা ডোবা জমিতে হেসেখেলে মাখানা চাষ করে। শীত সহজে কাবু করতে পারে না ফরিয়াদের। বিরামহীন পদাঘাতে পচা কাদা আরো পচে ওঠে। কাদা পচাতে দোসরহীন তারা। লাথালাথি বা কখনো ডুব দিয়ে দু’হাতে কাদা মর্দন করে। নরম কাদা আরও পিচ্ছিল চিকন হয়। তবেই ষোলআনা মাখনা ফলে।

কাদা-খিঁচ মেখে লছমিয়া আর ভিকু পাহাড়িয়া ওপরে ওঠে। একে অপরকে ভূত দেখে। সবই বিবর্ণ ম্লান। ঠোঁটের হাসিটুকু ঝরে তবুও। আরেক কারণে এ হাসি চওড়া হয়। আড়তদার বিভু মাড়োয়ারি মাহিনা চুকায় যখন।

মাখনা চালান করে বিভু। গদিতে হেলান দেওয়া এখন আরও বেড়েছে। কথা বলতে যাও, ফুলোগাল নিয়ে ইঙ্গিত করবে এখন সময় নেই তার। কথা কম বলে। মুখে রজনীগন্ধা পানমশলার থুথু। আজকাল দু’শো টাকার থুথু ফেলে। কথা বেশি বলে আঁতের লোকের কাছে। লছমিয়ার সাথে হেসে-খেলে কথা কয়। লছমিয়ার নাম দিয়েছে মাখনিয়া।

পদ্মপাতের ন্যায় মাখনাগাছ বেড়ে ওঠে। জলের থালা যেন। ভিকু পাহাড়ি হেসে ওঠে তা দেখে। আহা রে! এতে যদি ভাত খাওয়া যেত। শীতে গ্রীষ্মে জলে ডুব দেওয়া ছাড়ত। এই পাতা বেচত ভোজবাড়ি বা হোটেলে। আজকাল হাঁপের রোগটা ঝিট্‌কে মারে। জলে ডুবতে ভয় লাগে। দম হারায় যদি। সাহস জাগে লছমিয়াকে দেখে। তার দ্বিগুণ কাজ টানে সে। ডুব দিয়ে কাদা গিঁজতে পারে অনেকক্ষণ। সঙ্গে মনে পড়ে গেল গত বছরের কথা। মাখনার ফল পেকেছে। ঝরে জলের পাঁকে মিশেছে। মাস কয়েক বাদে সেই দানা আড়তদারদের জিভে জল এনেছে। পাঁকের মধ্যে কালো কুচকুচে রঙ পেয়েছে। কালো জাম যেন। আড়তদাররা এই দানাকে গুড়িয়া বলছে। গুড়িয়া সে বছর সোনার দর। আড়তদাররা মাখনা জমির মালিকদের ‘অগ্রিম’ দেওয়া ধরল সে বছর।

ভিকু-লছমিয়াদের কদর বাড়ল। সঙ্গে মজুরি। কেউ পারে না ওদের মতো লাওয়া বের করতে। গুড়িয়ার ভেতরে লাওয়া আত্মগোপন করে রয়। ভুট্টার খৈ আর লাওয়া যেন দুই ভাই। এই লাওয়া বিদেশে দৌড়ায়। ধনী বিলাসীদের জিভ লাওয়ার জন্য লক্‌লক্‌ করে।

এবছরে ফরিয়াদের ঝাঁক এসেছে। দেখে জমির মালিক হাসে মহানন্দে। মাখনাচাষী পাওয়া বড়োই কঠিন। গাঁও-ঘরের ছেলেরা দিল্লি মুম্বাই কেরালায় মিস্ত্রীর কাজ শেখে। টাইল্‌সের কাজ করে। তবু মাখনাচাষী হতে চায় না। মাখনাপাতার কাঁটার আঁচড় খেয়ে গতরের রক্ত ঝরাতে চায় না। মাছধরা টাপার মতো গাইঞ্জা দিয়ে কাদার মাখনা ছাঁকবে কেন। তাদের হাতে কুর্নি, শাইল, হাতুড়ি। গাইঞ্জা ধরবে কোন্‌ দুঃখে।

সাঁঝ ঘনালেই ভিকু লছমিয়ারা চাষী থাকে না। তারা তখন রাজপুত্র রাজপুত্রী। তেঁড়ামেড়া হাঁড়িতে মাংসের ভাপ উর্ধ্বধাবী হয়। ভাত কী রুটি সামান্য, তবে মাংসের পরিমাণ অঢেল। সাথে দারুর লাল রঙ বোতল ঠিক্‌রে বেরিয়ে আসে। চলে রাত দশটা অব্‌দি মৌজসাগরে স্নান। আজকাল বিভু তাদের শরীক। দু’ঢোক দিয়ে লছমিয়ার চিকন বক্ষের স্বাদ নেয়। ভিকুয়ার ঢালা মদ খেয়ে গেলাস বাড়ায় লছমিয়ার দিক। “জারা আওর দো না মাখনিয়া” কথা শোনে লছমিয়া। নজরে পড়ে বিভুর হাতখানি তার বক্ষসম্পদের কাছে উঠেছে। ভিকুয়া ততক্ষণে রাজপুত্র হয়ে পড়েছে। গাঁজলা ওঠা মুখ নিয়ে ঘুমের ঘোরে হাসে। বিভু মাখনিয়ার দু’হাত চেপে ধরে। বিনি কাটে বগল পর্যন্ত। মাখনিয়া মদের ঘোরে জবাব দেয়, “আহ! কোই দেখলেগা। ছোড়িয়ে দো হাত।” বিভুর নাকে গরম বাতাস। বুনো শ্বাস উথলে পড়ছে। মাখনিয়ার হাতের তালুয় নিজের তালু ঘষে। মাখনিয়ার বাম তালু খরখর করে ওঠে। দ্রুত হাত ছড়িয়ে নেয় বিভু। সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করে “তোমার বাম তালু খস্‌খস্‌ করে কেন?”

মুচকি হেসে জবাব দেয় মাখনিয়া “কাল সুব্‌হামে আইয়ে, তব্‌ আপকো মালুম পাড়েগা মেরি হাতকা হালাত।”

দু’চোখ বোঁজেনি বিভু মাড়োয়ারি। মাখনিয়ার হাত বেশ গরম। নাকি মাখনিয়াকে আপ্যায়ণ দেওয়ার ইঙ্গিত দিতে ব্যর্থ হল সে। মাখনিয়াও হয়তো তাকে গরম রক্তের স্বাদ দিতে চায়ছিল। নানা ভাবনা বিভুর মনে হাঁটা দেয়।

ভোরের মুরগা ডাক দিতেই বিভু হাঁটা দিয়েছে। আমবাগানের পাশে আসতেই গা টা শিউরে উঠল। মুহূর্ত খানেক থমকে দাঁড়াল। পাশে সাহাদের কাঠের মিল। বিদ্যুতের আলো বাগানের উত্তর কোণটায় ছড়িয়ে পড়ছে। এক জোড়া লাল চোখ তাকে লক্ষ্য করে তাকিয়ে রয়েছে। পায়ের চটিখানি সজোরে চালিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকল। চোখ দুটি অন্তর্হিত হতেই সাহস পেল মনে। আজকাল এ তল্লাটে শিয়ালের উপদ্রব বেড়েছে। সড়্‌সড়্‌ শব্দ আসতেই বুঝল শেয়াল ছিল ওটি।

দাউদাউ চুলা জ্বলছে। ভিকু পাশে বসে নাগাড়ে লকড়ি ঠুঁসে চলেছে। লছমিয়া বারংবার বালিতে হাত ঢুকাচ্ছে। বের করছে হাসি মুখে। হেসে স্বামীকে আদেশ করছে “কাড়্‌হাই আভিতাক্‌ গর্‌ম নাহি হুয়া। জিয়াদা লাক্‌ড়ি ঘুসাও।”

ভিকু বেশি পরিমাণ বাখারি চুলার মুখে ভরে দেয়। লেলিহান শিখা ছোবল দিয়ে ওঠে। ভিকু সরে যায় দূরে। লছমিয়া সরে না। সে হটে গেলে চলবে কী করে। গরম বালি হাতে নেড়ে স্বামীকে ইতিবাচক সম্মতি দেয়। বালি তেতে উঠেছে। এবার গুড়িয়া ঢালতে হবে কড়াইয়ে। তাপ খেয়ে কালো গুড়িয়া আরও পিচ্‌কালো রূপ ধরে। ফট্‌ফট্‌ শব্দে ফুটতে থাকে। যত ফোটে লছমিয়ার মন খুশিতে ভরে ওঠে। এবার গুড়িয়ার মধ্য থেকে লাওয়া খৈ বেরিয়ে আসবে। তার দু’হাত ব্যস্ত এখন। ডান হাতে মোটা লাঠিখণ্ড আর বাম হাতে গরম বালুর ছ্যাঁকা। বাম হাতের আঙুল যেন চালুনি। বালিতে হাত দিয়ে গুড়িয়া তোলে। ডান হাতের লাঠি সজোরে আঘাত করে গুড়িয়াকে। মাপসই আঘাতে আবরণ খসে পড়ে। ফুটফুটে সাদা লাওয়া বেরোয় শিশুর দুধদাঁতের ন্যায়। দু’একখানা স্বামীকে দিয়ে নিজের মুখে দেয়। স্বাদ চাখে। মনভোলানো স্বাদ পেয়ে স্বামীর দিক নজর দেয়। মুচকি হাসে “কৈসা হ্যায়?”  এক সময় মাড়োয়ারিকে ডাক দেয়—“আইয়ে। আপভি মুমে ডালিয়ে দো এক। বহুৎ ওয়াক্ত বিতায়া ছুপাকে খাড়া হোকার। আইয়ে, লিজিয়ে।”

বিভু অপ্রতিভ হায়। মাখনিয়া কখন দেখল তাকে গাছের আড়ালে! কাছে আসতেই মাখনিয়া বলল—“আপকো আজ পাতা চালা কিঁউ মেরি বাঁই হাতকা হালাত আইসা? কল্‌ সামকো ইস বারেমে আপ পুছাথা।”

ভিকু বৌয়ের দিকে তাকায়। পরে মাড়োয়ারির দিক। মাড়োয়ারি অতি চালাক। ধুরন্ধর। “আচ্ছা” বলেই সেখান থেকে কেটে পড়ে।

মাখনাগাছ গাছ বটে! একবার রোপণ কর, দশবার ফল খাও। মাটির জল যেমন। যতই খুঁড়বে ততই বেরোবে। পাকা দানা গুড়িয়া। পাঁকে শুয়ে রয়। একবার দু’বার তিনবার চারবারেও তুলে শেষ করা যায় না। চাষীরা যতবার গাইঞ্জা মারে ততবারই ওঠে। ‘লসার’-এ বেশি ওঠে। ‘মার্কেটিং’-এ একটু কম। ‘সার্কেট’-এ আর এক চিমটি কম। উঠতে থাকে প্রতিবার। বিদেশের বাজার গরম থাকলে মালিকদের লোভ বাড়ে। বারবার জলে নামতে হয় লছমিয়াদের। ‘ছেঁকে আরও তোলো’ আদেশ আসে জমিওয়ালাদের। প্রথম বার, দ্বিতীয় বার, তৃতীয় বার তোলাকে জমিওয়ালারা নাম দিয়েছে লসার, মার্কেটিং, সার্কেট। চার বার তোলাকে বলে কম্পিউটার। কেন এ নাম তা লছমিয়ারা জানে না। কেবল জানে লসার শেষ হলেই মার্কেটিং আসে। অবশ্য মাস খানেক বাদ। লছমিয়ারা এক সময় আশা ছাড়ে। আর পাঁকে গুড়িয়া নেই। ভুঁইওয়ালা হাসতে থাকে লছমিয়াদের হতাশা দেখে। না বলা, না কওয়া; হঠাৎ পাতা নিয়ে মাথা তুলে মাখনা গাছ। ভুঁইওয়ালা হাসে টাকার গন্ধে। লছমিয়ারা হাসে রোটি কাপড়া আওর মাকানের টানে। এক বার কষ্টসিষ্টে চারা লাগালেই হল। ফি-বছর ফল দেয়।

পৌষের শেষ দিক বিভু হাজির একগুচ্ছ টাকা নিয়ে। জাপান কোরিয়ায় এবার মাখনার আকাল। ভারত চীনের মাখনার দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ভিকুর হাতে আগাম টাকার গুচ্ছ গুঁজে দেয় বিভু। আর ব্যাগ থেকে বিলেতি মদের বোতল বের করে ভিকুর ঘরে রেখে আসে। কাল সকালে জলে নামতে হবে। সার্কেট করতে হবে। লছমিয়া আপত্তি জানায়। “তিন চার দিন হামলোগ পানিমে নাহি উতরেঙ্গে।”

বিভুর গলায় গম্ভীরতা আসে—‘কিঁউ’?

—“কিঁউ ক্যা? বোল দিয়া তো বোল দিয়া।”

—“কুচ তো কারড়ঁ হ্যায়?”

—“তাবিয়াত সাহি নাহি হ্যায়।”

বিভু মাখনিয়ার দিক একদৃষ্টে চেয়ে রইল। শরীরে চপলতা নেই, মুখখানি বিবর্ণ ম্লান। চোখ রক্তাভ। বিভুর শ্যেনদৃষ্টি মাখনিয়ার শরীরের ভাষা অনুধাবন করল মুহূর্তে। মাখনিয়ার লাজরক্ত বইছে। মেজাজ এখন খিটমিটে। তাকে না খ্যাপানোই ভালো।

সকালে হুলুস্থূল পড়ল। ভীকু বস্তাচট গায় ঘোঁ ঘোঁ নাক ডাকছে। বিভুর চোখেমুখে আচঁড়। রক্তের দাগ কালশিটে সহ ফুটে উঠেছে। মাখনিয়া ক্রমাগত থাপ্পড় দিয়ে চলেছে মাড়োয়ারিকে। মাড়োয়ারি গর্জন করে চলেছে লছমিয়াদের পেশা ছাড়ানোর।

চারদিন বাদ জলে নেমেছিল লছমিয়ারা। কনকনে শীত হিমেল বাতাসে রক্ত জমাট করেছে। ভিকুর ঠোঁটের কাঁপন লছমিয়াকে ভয় ধরাল। দাঁতের কট্‌কট্‌ শব্দ আর হাড়পাঁজরের নীরবতাও লছমিয়ার বুকে বেজে উঠল। কাদা থেকে হিঁচড়ে তুলল ভিকুকে। সত্রাস চিৎকার করে উঠল বিভুর দিক তাকিয়ে।— “মালিক, জল্‌দি মোটা চাদ্দর লে আইয়ে। নাহি তো মর্‌ জায়েগা হাম্‌রি ভিকু।”

তার হাত দুটো কেঁপে চলেছে। ছিপি খুলতে পারল না। কাদাগায়ে দৌড় দিল আমগাছটার দিক। ডালে সজোর আঘাতে বোতলের মুখ ভেঙ্গে ফেলল। ঢোক দুয়েক ভিকুর মুখে গল্‌গল্‌ করে ঢেলে ফেলল দারুর তরল। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বস্তা-চট ভিকুর গায়ে ফেলে দু’হাত জড়িয়ে তার উপর শুয়ে পড়ল লছমিয়া। এক সময় লছমিয়া নিজের গা-ঝাকানি অনুভব করল। ভিকুর উপর থেকে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। চোখ দুটি বুঁজে এল।

বিভু গায়ের কম্বলখানি লছমিয়ার গায়ে ফেলে দিল। বোতলের অবশিষ্টাংশ দারু গলায় ঢালল। গা গরম হল মুহূর্তে। ক্ষুধা তাড়া দিল বিভুর রক্তে। কম্বলের ভেতর সন্তর্পণে ক্ষুধা ঠাঁই নিল।

লছমিয়া অকালতপ্ত হয়ে উঠল। কম্বলের তলায় অনুভব করল রক্তরাক্ষসের স্পর্শ। রাক্ষসবধ ছাড়া উপায় নেই। সজোরে বিভুর বুকে লাথি দিয়ে বেরিয়ে এল।

রক্তবীজের উন্মাদনায় বিভু সত্যই রাক্ষস। খুবলে খেতে লছমিয়ার দিক এগিয়ে আসে। বক্ষদ্বয় দু’হাতে জড়িয়ে লছমিয়া ছুটতে থাকে। বিভুর মাতাল কানে ভেসে আসে মাখনিয়ার আর্তনাদ—“হামলোগ পাহাড়কি উঁচাই মে রহতেহে। তুম যাইসা নীচমে নাহি।”



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code

Responsive Advertisement