১) রাতের ট্রেন
রাতের ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখা
কুয়াশাঘেরা অচেনা স্টেশন –
যাকে তুমি ভুলতে পারোনি
সে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে চিরকাল ...
২) নীল খাতা
তোমায় আমি ভুলতে চেয়ে রঞ্জিনী
বাজার থেকে হিসেব করে ছাই কিনি
উড়িয়ে দেওয়া মেঘের মতো এক সফর
পুড়িয়ে দেওয়া হাসির মতো খন্ডহর –
এ সব নিয়েই হাঁটতে বেরোয় কলকাতা
ক্যাকোফোনির মধ্যে ভাসে নীল খাতা
তোমায় আমি মারতে চেয়ে রঞ্জিনী
ব্যাকপকেটে মেশিন রাখি, রাগ কিনি
বুলেটপ্রবণ গুপ্তখুনের এই দিনে
আমার কফিন ধুলোয় বসে গান শোনে...
৩) স্ট্র
পার্কিনসন্স-এ হাত কাঁপে
গেলাস তুলে খেতে পারেন না জল
জলপানের জন্যে চেয়েছিলেন একটা স্ট্র
স্ট্র ও জামিন মহার্ঘ বস্তু, মেলেনি
বিনা বিচারে ন' মাস
বিনা চিকিৎসায় কয়েক জন্ম
জেল থেকে অনেক অনুনয়ের পরে হাসপাতাল
হাসপাতাল থেকে গ্রহান্তর -
ফাদার স্ট্যান স্বামী , আপনি কি মাওবাদী ?
ঝাড়খন্ড-জঙ্গলের আদিবাসীরা আপনার ভাই
ইঁদুরের মাংস খাওয়া কালো চামড়া, শীর্ণ দেহরা আপনার পরিজন-
ফাদার স্ট্যান স্বামী,
আপনি কি পাদ্রী না টেররিস্ট ?
অশীতিপর বৃদ্ধকে এত ভয় পায় কারা ?
পার্কিনসন্স-এ হাত কাঁপে, তবু হাত-পায়ে শেকল পরিয়ে রাখে কারা ?
বিনা বিচারে ন মাস
তারপর একটি ঠান্ডা মাথায় খুন -
ফাদার স্ট্যান স্বামী , আপনি আমাদের ক্ষমা করুন
দেশ ও রাষ্ট্রের মধ্যে
সংবিধান ও বিচারব্যবস্থার মধ্যে
আপনি সেই স্ট্র
যা যুগ যুগ ধরে ছুঁচ হয়ে বিঁধে থাকবে
প্রতিটি শোষকের গলায় |
৪) এইসব জুলাইসন্ধে
আলোফোঁটা হয়ে ঝরে পড়া এইসব জুলাইসন্ধে
দু-একটা অস্পষ্ট ফোনকল , ঝাপসা চায়ের দোকান
কেউ আসার কথা ছিল ?
গাড়িবারান্দার নীচে বছরগুলো ভিজে চলে অবিরাম
জোনাকি-ট্রামের হাওয়া , শুনশান ময়দান এলাকা
মনে পড়া ভালো
আরও ভালো মনে করে ভুলে যাওয়া , নিয়মমাফিক ...
৫) চেক ইন আর চেক আউটের মধ্যে
যে সব শহরে হয়ত আর যাওয়া হবেনা কখনো
যে সব হোটেলের ঘরে কাটিয়েছিলাম কয়েকটা দিন
প্রতিবার যে সব ঘর থেকে চেক আউট করবার সময়ে
মনে হয় কী যেন ফেলে গেলাম
চেক ইন আর চেক আউটের মধ্যে
বিছানায় বসে থাকে টুকরো জীবন
অথবা বসে থাকো তুমি...
দরজা টেনে দিয়ে , লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে যাই প্রতিবার
রুম-কি রিসেপশনে জমা দিতে গিয়ে বুঝি
মোবাইল চার্জার নয় , হাতঘড়ি নয় , আরও অন্য কিছু ভুলে যাচ্ছি
আরও অন্য সব ধূসর, ঝাপসা, নীল...
৬) সান্তা বারবারা
সান্তা বারবারা-র ভাইনইয়ার্ডের পাশে
ওক গাছেদের প্রাচীন পাড়ায়
একদিন দেখা হবে , জুলিয়ানা মারিয়া স্মিথ
যা যা কিছু বলা হয়ে ওঠেনি
যে যে উপত্যকা বেয়ে
পৌঁছনো বাকি ছিল অনিবার্য নাব্যতায়
সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার স্বর্ণকেশী রোদে
হাওয়ার সমুদ্রের ভেতর
তাদের দেখা হবে উদাসীন স্যাক্সোফোন-সকালে
বিচ-রিসর্টের ঘরে সেদিন আশ্চর্য রামধনু ...
৭) মেঘমল্লার
চৈত্র দিনের শেষে আচমকা অন্যমন এই কলকাতা
ভাঙাচোরা গলি - অসহায় ও শর্তবিহীন
অপসৃয়মান রোদের ট্যাক্সিতে সওয়ার অনিশ্চিত প্রেম-প্রস্তাব
জি.পি.ও.-র সামনে ইতস্তত ভিড় -
রেসের মাঠের সন্দেহজনক বুকি
দেশলাই চায় হাইকোর্ট-উকিলের কাছে
বন্ধ স্টক এক্সচেঞ্জের রাস্তায় হেঁটে যায় হারানো কলিগ
আচমকা অন্ধকার চারদিক
তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো ছুটে যায় ত্রস্ত বাস
হাওয়ায় উড়ে যায় বাড়ি-ঘর-লোক
আকাশের দিকে মাথা তুলে মনে পড়ে –
দুঃখ ও উচ্ছলতার ভেতর ভেসে থাকা
তোমার আশ্চর্য মুখ , সেইসব মেঘমল্লার ...
৮) রেজর
আরো অনেক কিছুর মতোই
পুরুষদের দাড়ি কাটা ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝিনা
যে সব কবিতা হবার কথা নয়
সে সব হয়না
তবু , মাঠাবুরু পাহাড়ের কোলে , পলাশ-উৎসবে
রঞ্জাবতীদি গালে আবির এঁকে দিয়েছিল সেই কবে
হাজার জনপদ আর শেভিং ফোম পেরিয়ে এসেও
সেই জন্মদাগ মোছা যায়নি এখনো
তাই রেজরের ব্যবহার স্বচ্ছন্দে ভুলেছি ...
৯) সৎকার
মার্চের চোরাটানে জেগে ওঠে ফাগুন-পরব
সোনাঝুরি বনে ওড়ে কবেকার দু মুঠো আবির
গাছের আড়াল থেকে আরো সব গোপনের দিকে
কারা যেন চলে যায় ফেলে দিয়ে শাসনের দিন
ধুলো ওড়ে , পথঘাটে শিমুল-আগুন
এরই মাঝে, রোদে পোড়া ঠোঁট নিয়ে
মরে যায় কিছু কিছু লোক
আমি ডোম, তাদের সৎকার করি নির্জনে
নদীতীরে ধোঁয়া ওড়ে , সে ধোঁয়ায় আমিও মিলিয়ে যাই শেষে।
১০) হয়ত
একদিন তুমি কারুর জন্যে পাগল হয়েছিলে -
ফোনের পর ফোন , মেসেজের পর মেসেজ
ছাইমেঘের পর ছাইমেঘ , বিকেলের পর অন্ধকার
অন্ধকারের পর আরো অন্ধকার
দিনগুলো, রাতগুলো ভাঙা নৌকায় সওয়ার
ঢেউ ছোঁয়নি , শুধু সাইক্লোনে ভেসে গেছে মন
একদিন তোমার জন্যে কেউ উন্মাদ হয়েছিল -
ফোনের পর ফোন, মেসেজের পর মেসেজ
সম্ভাব্য সম্পর্কের প্রোটোকল ভেঙে অসহায় আত্মসমর্পণ
তোমার বন্ধ দরজার সামনে উড়ে যাওয়া বিষণ্ণ রুমাল
তুমি পালিয়েছো ঘা খাওয়া জন্তুর মতো
সূর্য ওঠেনি, শুধু উত্তুরে হাওয়ায় ভেসে এসেছে দুঃসংবাদ
মাঝখানে , বয়ে গেছে জীবন
মাঝখানে , হেসেছে জীবন
আর কিছু ঘটেনা
আর কিছু ঘটার কথা থাকে ?
আর কিছু ঘটতেও পারতো , হয়ত
হয়ত নয়।
0 মন্তব্যসমূহ